নাছিমা আক্তার পড়াশুনা করেছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। ১৯৯২ সালে তার বিয়ে হয় বিডিআর সদস্য মীর রবিউল আলম বাচ্চুর সঙ্গে। ২০০০ সালে বাচ্চু অবসর গ্রহণ করেন। স্বামী অবসর গ্রহণের পর কিছু টাকা পেয়েছিলেন। যৌথ পরিবারের সাংসারিক কাজে সেই টাকা ব্যয় হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে থ্রি পিস, শাড়ি আর নকশিকাঁথা সেলাই করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। ২০১৭ সালে তিনি প্রথম কাগজ দিয়ে এই কলম তৈরি করেন। সেই কলম বাজারে বিক্রি করা নিয়ে লোকলজ্জা কাজ করছিল। গত বছরের জুনে অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার দেখা দিলে সব সংশয় দূরে সরিয়ে নাছিমা প্রথম একশ’ পিস হাতে তৈরি কলম নিয়ে উপস্থিত হন যশোর সদরের বাহাদুরপুর স্কুলে। সেখানকার প্রধান শিক্ষককে তার তৈরি কলম দেখিয়ে সেগুলো বিক্রির অনুমতি চান। প্রধানশিক্ষক তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে খুব অল্পসময়ের মধ্যে সেগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে দেন। ওই শিক্ষকই তাকে পরামর্শ দেন, কলমগুলোতে যেন পরিবেশবান্ধব সিল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি ‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ সিলটি যুক্ত করে করে কলম বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন।
পরিবেশবান্ধব কলম
নাছিমার দু’সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ঢাকার একটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছেন। ছেলে মীর নাঈম আলম শুভ এবছর এসএসসি পাস করেছে।
নাছিমা বলেন, ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজ করতে ভালো লাগতো। বাড়িতে বসেই কাগজ, কাপড় আর সুতো দিয়ে নানারকম জিনিস তৈরি করতেন শখের বসে। সেই শখ নাছিমার পরিবেশবান্ধব কলম তৈরিতে পেনের রিফিল, এ-৪ সাইজের রঙিন কাগজ, ফেভিকল আঠা, কালার স্টিকার, স্ট্যাপলার পিন ব্যবহার করা হয়। কলম তৈরি শেষে পরিত্যক্ত কাগজ দিয়ে তিনি ফুলদানি, অ্যাশ-ট্রেসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে পারেন।এখন জীবিকার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে।
যশোর শহরের লোনঅফিস পাড়ায় নাছিমার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো, টিনশেড বাড়ির বারান্দায় বসে তিনি এই কলম তৈরি করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করছে ছেলে শুভ। সে কলমগুলো দোকানে দোকানে সরবরাহ করছে। কলম বিক্রির টাকায় সংসারে মোটামুটি সচ্ছলতা এনেছেন নাছিমা।
‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ প্রথমদিকে যশোরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতেন নাছিমা। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় কলম বিপণনে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে এখন তিনি বিভিন্ন অফিস, আদালত এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন।
পরিবেশবান্ধব কলম তৈরি করছেন নাছিমা
নাছিমা বলেন, ‘প্রথমদিনেই সব কলম বিক্রি হওয়ায় আমার সাহস বেড়ে যায়, উৎসাহ পাই। এরপর যশোর সিটি কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ডা. আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, এমএম কলেজসহ জেলার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ পিস কলম বিক্রি করি।’
তার মতে, দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার প্লাস্টিকের কলম ব্যবহৃত হয়। সেইসব কলম মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়, যা অপচনশীল। এ থেকে পরিবেশ নষ্ট হয়, মাটি ও বাতাস নষ্ট হয়। কিন্তু তার তৈরি কলমে কাগজের ব্যবহার হয়, কাগজ পচনশীল। সেকারণে ভোক্তাদের আগ্রহ থেকেই যায়।
প্রতিদিন তিনি দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ কলম তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি কলমি বিক্রি হয় ৫ টাকায়। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে দেড় থেকে দুই টাকা থাকে তার প্রতি কলমে।
পুলিশ সুপারকে কলম দিচ্ছেন নাছিমা
সম্প্রতি তিনি যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেনের দফতরে গিয়ে কলম বিপণনে তার সহায়তা চান। এসপি তার কাছ থেকে কলম কেনেন এবং পরবর্তীতে তার অফিসে যত কলম প্রয়োজন তার সবই নাছিমার কাছ থেকে নেবেন বলে জানান। একইসঙ্গে তিনি যশোর পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন।
নাছিমার ছেলে শুভ জানায়, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সেও কলম বিপণনে কাজ করে। যশোর পৌরপার্কসহ শহরের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে সে এসব কলম বাজারজাত করে।