অব্যবস্থাপনায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র ইমেজ সংকটে পড়েছে। ১০ বছর চারবার কেন্দ্রে বিদ্রোহ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। একাধিক বার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ তিন বন্দি কিশোরের হত্যা ও ১৫ জনের আহত হওয়ার ঘটনায় তোড়পাড় শুরু হয়েছে। বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদাসীনতা, অনিয়ম-দুর্নীতিতে কেন্দ্রে এ অবস্থা হয়েছে।
এদিকে তিন কিশোর হত্যা ও ১৫ জনকে আহতের ঘটনা তদন্তে গঠিত দুটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। দোষীদের বিচারের দাবিতে রোববার বিকালে যশোর শহরের দড়াটানায় মানববন্ধন করেছে সিপিবি। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে জাতীয় কিশোর সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব নয়।
জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নানা অসঙ্গতির বিষয় সামনে আসছে। সেই বিষয়গুলো ইতোমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা যাতে আগামীতে আর না ঘটে, সেই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল সংকট। তিনি বলেন, আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী বলা হলেও ২০ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিরা কেন্দ্রে আসে। তারা কেন্দ্রের অভ্যন্তরে আধিপত্য বিস্তার করে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি থাকায় কর্মকর্তারাও অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো সমাধান হয়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেকগুলো কারণে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হয়ে থাকে। প্রথমত, কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা নিরস্ত্র আনসার সদস্যদের অধিকাংশের শারীরিক ফিটনেস নেই। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে তারা প্রশিক্ষিতও নন। সঙ্গতকারণে তারা ‘গায়ের জোরে’ বন্দিদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। ফলে সব সময় গার্ড আর বন্দিদের মধ্যে একটা বিরোধ বেধেই থাকে। এজন্য মাঝেমধ্যেই হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে কম বেতনে চাকরি করা আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময়ে বন্দিদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কেন্দ্রে ১৮ বছরের কম বয়সীদের রাখার নিয়ম। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যকর হয় না। ১৮ বছরের বেশি হলে জেলখানায় পাঠানোর নিয়ম কিন্তু আদালতে বয়সের প্রমাণপত্র দেখিয়ে তারা এ কেন্দ্রে আসে। দীর্ঘদিন থাকার পর তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
দুই তদন্ত কমিটির কাজ শুরু: সমাজসেবা অধিদফতর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান সমাজসেবা অধিদফতর ঢাকার পরিচালক সৈয়দ মো. নূরুল বাসির জানান, যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত কিশোরদের সঙ্গে কথা বলেছেন। একই ঘটনার তদন্তে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবু লাইছকে প্রধান করে তদন্ত কমিটিও কাজ শুরু করেছে।
হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন : তিন কিশোর হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) যশোর জেলা শাখা মানববন্ধন করেছে। রোববার বিকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শহরের দড়াটানা মোড়ে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। বক্তব্য দেন জেলা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, জেলা সিপিবি নেতা অ্যাডভোকেট আমিনুর রহমান হিরু, মফিজুর রহমান নান্নু, বিথিকা সরকার, আবদুল জলিল প্রমুখ।
দোষীদের শাস্তি দাবি খেলাঘরের : যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে জাতীয় কিশোর সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’। রোববার সংগঠনটির সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সার ও সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে দায়িত্বশীল সরকারি সংস্থার ভেতরে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে এসব কেন্দ্র শিশুদের বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই।