দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো এই মানুষটির নাম পপি খাতুন, একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। সমাজ যাদেরকে এখনও করে রেখেছে অচ্ছুত, সুসময়ে অন্যান্য মানুষেরা যাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা বা বিদ্রুপে মেতে ওঠে। আজ সেই “অচ্ছুতেরাই” খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছেন তার দুয়ারে
সমাজে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক বেশি নিগৃহীত। কিন্তু নারী-পুরুষের তুলনায় আরও বেশি নিগৃহীত “তৃতীয় লিঙ্গের” মানুষ, বাংলাদেশের সমাজে যারা “হিজরা” বলে পরিচিত। সরকার তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সমাজ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, মেনে নেয়নি৷
ফলে প্রতিনিয়তই এই শ্রেণিকে সহইতে হচ্ছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অন্যায়-অত্যাচার। সমাজে একছত্রভাবে হাসিঠাট্টার পাত্রও এরা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব মোকাবিলায় গোটা দেশ যখন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, ঠিক এমন সময় সেই সংগ্রামে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
ঘটনাটা যশোরের বাঘারপাড়া পৌর এলাকার। বুধবার (০১ এপ্রিল) বিকেল, একটি ভ্যানে কিছু নিত্যপণ্য নিয়ে বাড়ি বাড়ি যান তিন-চারজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। বাড়ির লোকজনকে ডেকে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন একটি করে প্যাকেট। মুখেও ধরে রাখছেন সামান্য হাসি, বলছেন, “ভাল থাকিস, নিরাপদে থাকিস”।
দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো এই মানুষটির নাম পপি খাতুন, একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। সুসময়ে অন্যান্য মানুষেরা যাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা বা বিদ্রুপে মেতে ওঠে।
পপি যে মানুষটির হাতে খাবারের প্যাকেটটি তার নাম শ্যামলী খাতুন। বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া পৌর এলাকার মহিরণে।
প্যাকেট খুলে শ্যামলী দেখেন, ভেতরে চাল, ডাল, আলু আর সাবান। অপ্রত্যাশিত এই ঘঠনায় সীমাহীন খুশি হন তিনি। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকান তাদের দিকে, সমাজ যাদেরকে এখনও করে রেখেছে অচ্ছুত, আজ সেই “অচ্ছুতেরাই” খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছেন তার দুয়ারে।
শ্যামলী জানান, করোনাভাইরাসের কারণে তার দিনমজুর স্বামী গত তিনদিন হলো বাড়িতে বসে। ঘরে খাবার নেই বললেই চলে। না খেয়ে দিন পার করার মতো অবস্থা। ঠিক সেইসময় যেন ফেরেশতা হয়ে এলো পপি আর তার মেয়েরা।
তিনি বলেন, “আল্লাহ, ওগের আরও তৌফিক দেক; ওরা যেন গরিবির উপকার করতি পারে”, ঝরে পড়ে দোয়া, অন্তরের গভীর থেকে।
কেবল শ্যামলী একা নন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের প্যাকেট পেয়েছেন হাসপাতালের কর্মী চায়না খাতুন, দিনমজুর ওমর আলী, আলমগীরসহ অনেকেই।
তৃতীয় লিঙ্গের পপি বাঘারপাড়ায় রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। শহরের হাসপাতাল রোড এলাকায় তার বাড়ি। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি তার কোমল হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। তাই সাধ্য অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী নিয়ে বের হয়েছেন তিনি। সঙ্গে রয়েছেন তারই পোষ্য জুঁই, অজন্তা আর ইয়াসমিন।
করোনারভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে সরকার যে যার বাড়িতে থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। জরুরি সেবা বাদে সারাদেশে সব অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে দুর্বিষহ সময় পার করছে খেটে খাওয়া মানুষের- তারা এখন পুরোপুরি কর্মহীন।
খাদ্যসামগ্রী পাওয়া দিনমজুর ওমর আলী ও আলমগীর বলেন, কাজ নেই, বাড়ি বসে আছি- সংসার চলে না। ঠিক সেইসময় পপির মতো কেউ এসে আমাদের খাবার দিয়ে যাবে, কখনোই তা ভাবিনি। আল্লাহ ওরে বাঁচায়ে রাখুক, সেই দোয়া করি।
সরকারের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন এবং একার পক্ষে তা সম্ভবও নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষেরা এগিয়ে আসছেন ব্যক্তিপর্যায়ে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। পপি খাতুনসহ অন্য তিনজন মানুষের পাশে দাঁড়ানো সেই মানুষদেরই প্রতিচ্ছবি।
পপি তার তিন পালিতকে নিয়ে বুধবার দিনব্যাপী বাঘারপাড়া পৌরসভার ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্বল্প আয়ের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ছেন খাদ্যসামগ্রী। তার এই কর্মকাণ্ড অবাক করেছে স্থানীয়দের, ভালোবেসে সাধুবাদ জানিয়েছেন সমাজের প্রগতিশীল মানুষ।
পপির প্রতিবেশী হিরু আহমেদ বলেন, “পপি যে এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন- তা এলাকায় প্রশংসিত হয়েছে।”
বাঘারপাড়া পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোস্তাক আহমেদ বলেন, “পপির বাড়ি বাড়ি খাবার বিতরণের কথা আমি শুনেছি। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তার দেখাদেখি আরও অনেকে এভাবে উদ্বুব্ধ হবে বলে মনে করি।”
জানতে চাইলে পপি খাতুন বলেন, “সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি যে যার জায়গা থেকে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।” তার এই কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।