যশোর জেলায় আর্সেনিক প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। নতুন নতুন এলাকায় আর্সেনিকের বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি আসের্নিকমুক্ত পানির গড় গভীরতাও বাড়ছে ব্যাপকগতিতে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে গভীর নলকূপসহ নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে আর্সেনিকের বিস্তারের বিষয়ে কিছুই জানে না স্বাস্থ্য বিভাগ। এজন্য ন্যূনতম কোনো তৎপরতা নেই বিভাগটির।
আর চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে আর্সেনিকের প্রভাব সহসাই বোঝা যায় না। এর জন্য ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর মোশাররফ জানান, জেলার ৫টি উপজেলার নতুন নতুন এলাকায় আর্সেনিকের বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার কাশিমপুর, চাঁচড়া ও চুড়ামনকাটির ৬টি গ্রাম, বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট, জামদিয়া ও নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ৪টি গ্রাম, মণিরামপুরের শ্যামকুড় ইউনিয়নের একটি গ্রাম, ঝিকরগাছার মাগুরা, হাজীরবাগ ও শংকরপুর ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম এবং শার্শা উপজেলার লক্ষ্মণপুর, ডিহি ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রামসহ ২০টি গ্রামে আর্সেনিকের বিস্তার ঘটেছে।
তিনি জানান, আর্সেনিকমুক্ত পানি আগে যে গভীরতায় পাওয়া যেত, সেই গভীরতায় এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আরও গভীরে যেতে হচ্ছে। আগে যেটা একশ’ মিটারেরও কম গভীরে পাওয়া যেত, এখন তা এলাকাবিশেষে আড়াইশ’ মিটারেরও নিচে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৭৮ মিটার, বাঘারপাড়ায় ১৮৮ মিটার, অভয়নগরে ২৫৫ মিটার, মণিরামপুরে ২২০ মিটার, কেশবপুরে ২৫০ মিটার, ঝিকরগাছায় ২০৭ মিটার, শার্শায় ১৯৮ মিটার এবং চৌগাছায় ৪৪ মিটার গভীরে গেলে তবেই আর্সেনিকমুক্ত পানি মিলছে।
তিনি আরও জানান, পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থবছরে জেলার সদর, মণিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলায় ৫৪৮টি ৬নং গভীর নলকূপ, এক হাজার ৫৫৮টি গভীর নলকূপ, ৩৮৬টি পিএসএফ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে কেশবপুর উপজেলায় ২টি রুরাল পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম হাতে নেয়া হয়েছে।
তবে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এতসব উদ্যোগের ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই স্বাস্থ্য বিভাগের। উপজেলা থেকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তাই আর্সেনিকের ব্যাপারে তেমন কোনো খবরই রাখেন না। কেশবপুর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. হারুন অর রশিদ বলেন, তার উপজেলায় চারশ’র ওপরে রোগী রয়েছে। তারা ২০১২-১৩ সালের।
গত একবছরে এখানে নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি। সদর উপেজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক রাজু বলেন, এখানে ২০১৫ সালে ২৭৩ জন রোগী ছিল। বার্ধক্যসহ নানা রোগে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রোগী পাওয়া যায়নি। এ উপজেলায় আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগীদের তার উদ্যোগে বিশেষ স্বাস্থ্য পরামর্শ ও ভিটামিনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
চৌগাছার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাসুদ রানা বলেন, তার উপজেলায় নতুন ৬ জন রোগী পাওয়া গেছে। তবে এ সংখ্যা বেশি না বলে উদ্বেগের কিছু নেই। মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ, ঝিকরগাছার ডা. মো. শরিফুল ইসলাম এবং অভয়নগরের ডা. এমএম মাহমুদুর রহমান রিজভী জানান, তাদের উপজেলায় নতুন কোনো রোগী নেই। পুরানো রোগীদের কোনো তথ্যও তাদের জানা নেই।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার রায় জানান, স্বাস্থ্যশিক্ষার কারণে আর্সেনিকের প্রবণতা কমে এসেছে। তবে আর্সেনিক নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো প্রকল্প না থাকায় হালনাগাদ তথ্য তার বিভাগে সেভাবে নেই। চার বছর আগে চৌগাছা, শার্শা, ঝিকরগাছা, কেশবপুর ও সদরের কিছু এলাকায় রোগী ছিল। এদের মধ্যে বিভিন্ন অসুস্থতায় কারও কারও মৃত্যু হয়েছে।
যশোর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. এবিএম সাইফুল আলম বলেন, আর্সেনিকোসিস রোগী মাঝেমধ্যে পাই। তারা সাধারণত অন্য সমস্যা নিয়ে আসে। এই হাসপাতালে আর্সেনিকোসিস পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই বলে আমরা ঢাকায় রেফার্ড করি। ‘রেইন ড্রপ পিগমেন্টেশন’ হয়ে তাদের হাত-পায়ের চামড়া কালো ও খসখসে হয়ে যায়।
চামড়ার অবস্থা দেখে বুঝতে পারি তারা আক্রান্ত। দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ থাকলে ত্বক, কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে এ রোগ হঠাৎ করে হয় না। ৫ থেকে ১০ বছর অসংক্রামক এ রোগটি শরীরে সিমটম ছাড়াই বাসা বেঁধে থাকতে পারে।