যশোরে এবার অনুকূল আবহাওয়া, সময়মতো সার, বীজ, কীটনাশক কৃষকের হাতের নাগালে থাকায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। তবে বাজারে ধানের মূল্য অনেক কম থাকায় এই বাম্পার ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। তাদের মাথায় হাত উঠেছে।
যশোর জেলার আট উপজেলায় এ বছর ১ লাখ ৬৩ হাজার ১শ’ ৪০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ২৬ হাজার ৩শ’ হেক্টর, শার্শায় ২৩ হাজার ৪শ’ ৫০, ঝিকরগাছায় ১৮ হাজার ৯শ’ চৌগাছায় ১৮ হাজার ৩শ’ অভয়নগরে ১৪ হাজার ৩শ’ ৫০ হেক্টর, বাঘারপাড়ায় ১৬ হাজার ৭শ’ ৩০ হেক্টর, মণিরামপুরে ২৯ হাজার ৯শ’ ও কেশবপুরে ১৫ হাজার ২শ’ ১০ হেক্টর। এবার আশার কথা হচ্ছে, যশোরের কোথাও ব্লাস্ট মহামারী আকার ধারণ করেনি। সর্বোপরি যশোরে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চৌগাছা উপজেলার সলুয়া, আন্দুলিয়া, বর্ণি, রামকৃষ্ণপুর, পুড়াপাড়া, সিংহঝুলি, বাড়িয়ালী, পাশাপোল, বুন্দেলিতলা, খড়িঞ্চা এলাকার মাঠ ঘুরে জানা যায়, উপজেলার কৃষকরা বাসমতি, তেজ গোল্ড, এসি আই-২, হাইডিব্রিড ১২০৩, শুভলতা, কাজললতা, মিনিকেট, ব্রি-২৮, ব্রি-৫০, ব্রি-৫৮ ব্রি-৬৩, ব্রি-৫৮, ৮১ প্রভৃতি জাতের ধান চাষ করেছেন। এই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে বাসমতি ও শুভলতা ধানের। তবে বোরো বাম্পার ফলনেও বাজারে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কৃষকের মাথায় হাত উঠেছে। বর্তমানে ব্রি-৬৩ ও শুভলতা ধানের বাজার মূল্য ৬শ’ ৮০ থেকে-৭শ’ টাকা, মিনিকেটের ৮শ’ থেকে ৮শ’১০ এবং বাসমতি ৮শ’৪০ থেকে ৮শ’৫০ টাকা।
অন্যদিকে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতাংশে) এলাকাভেদে কৃষকের উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ১৮ হাজার ৮ শ’ টাকা পর্যন্ত। তাদের উৎপাদন হয়েছে ২২ থেকে ৩৪ মণ পর্যন্ত। যেসব প্রান্তিক চাষী জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ করেছেন তাদের উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিঘাপ্রতি লিজমূল্য চারহাজার টাকা যোগ করলে বিঘাপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে লোকসান হচ্ছে। চৌগাছা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রটিও কৃষকদের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান বাজারে ন্যায্য মূল্য নেই। কৃষকরা অবশ্যই ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। চৌগাছার আড়ারদহ গ্রামের জামাল উদ্দিনের হিসাবে তার বিঘাপ্রতি ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৮শ’ টাকা (চাষ-১ হাজার, নিড়ানো-১ হাজার, ধানের চারা ক্রয়-১ হাজার ৫শ’, রোপণ-১ হাজার, সার ৩ হাজার, সেচ-১ হাজার ৫শ’, ধান কাটা ও ঝাড়া-৪ হাজার, পরিবহন-৮শ’ টাকা)। অবশ্য ধানের চারা নিজের হলে খরচ এক হাজার কমেছে। আবার লিজ নিলে পাঁচ হাজার বেড়েছে। আর বিঘাপ্রতি ব্রি-৬৩ জাতের ধান উৎপাদন হয়েছে ২০-২২ মণ। তবে শেষ সময়েও ধানকাটা শ্রমিকের সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। খরচের হিসেবে দেখা যাচ্ছে এক বিঘা জমির ধান কাটা-ঝাড়াতেই প্রায় চার হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। যা মোট খরচের এক-চতুর্থাংশ। চাষীরা বলছেন, চলতি মৌসুমে সার, বীজ, কীটনাশক বা ডিজেল পেতে কোন সমস্যা হয়নি। বিদ্যুত সরবরাহ ছিল ভাল। তাছাড়া মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে পরিমাণ মতো বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধানের ভাল ফলন হয়েছে। সরকারীভাবে ধানের যে ক্রয় মূল্য সেটা পর্যাপ্ত হলেও চাষীদের কাছ থেকে তো সরকারীভাবে ধান ক্রয় করা হয় না। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। বাজারে এক হাজার থেকে এগারোশ’ টাকা মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারলে তাদের পরিশ্রম সার্থক হতো। চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রইচ উদ্দীন জানান, আমরা সব সময় কৃষকের পাশেই আছি। মৌসুম জুড়ে আমার সহকর্মীরা কৃষকদের সহযোগিতা করেছেন।
মনিরামপুরের চাঁদপুর-মাঝিয়ালী গ্রামের প্রান্তিক চাষী নিরঞ্জন দাস জানান, তিনি এবার মোট ১৬ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। তার হিসেবে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচসহ প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে গড়ে এক হাজার টাকা। কিন্তু তিনি মোটা ধান বিক্রি করেছেন সাত’শ টাকা মণ দরে। নিরঞ্জন দাস বলেন, এত কষ্ট করে লাভের পরিবর্তে প্রতিমণে দুই থেকে তিন’শ টাকা লোকসান দিয়ে ধারদেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে। একই কথা বললেন উপজেলার লাউড়ি গ্রামের আকরাম হোসেন, ফজলুর রহমান, পৌর শহরের কামালপুর এলাকার আব্দুল জব্বার মোড়লসহ অনেকে। মনিবামপুরের রাজগঞ্জ, নেগুড়াহাট, খেদাপাড়া, চিনাটোলা, নেহালপুর, ঢাকুরিয়াসহ পৌর শহরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা ধান প্রতিমণ সাত থেকে সাড়ে সাতশ টাকা, মিনিকেটসহ চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে সাতশ থেকে আটশ টাকা, বাসমতি, জিরা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে নয়শ থকে নয়শ পঞ্চাশ টাকা মণ। রোহিতা গ্রামের বোরো চাষী আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘ধানের বাজার মূল্য এত কম থাকলে লোকসান করে আর ধান চাষ করব না’। সেচযন্ত্র মালিক আনছার আলী জানান, তিন মাস বাকিতে পানি সেচ দিয়ে ধান কাটার পর সেই টাকা আদায় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর ধানের দাম কম থাকায় কৃষকরা বকেয়া পরিশোধ করতে তালবাহানা করছেন। মধ্যস্বত্বভোগী মোদাচ্ছের আলী জানান, বোরা চাষের শুরুতেই কৃষকদের অগ্রিম টাকা দিয়েছি। কৃষকরা এখন টাকার পরিবর্তে ধান দিয়ে দেনা শোধ করছেন। মনিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম থাকার কথা স্বীকার করে জানান, বর্তমান বাজারদরে কৃষকদের লোকসান হচ্ছে।