নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে যশোর অঞ্চলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা, অসাধু শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতি এ ব্যবসার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। শিক্ষর্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে। নিষিদ্ধ নোট গাইড ও গ্রামার বইয়ের উচ্চ মূল্যের কারণে ম্লান হচ্ছে সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্য বই বিতরণের সাফল্য।
এদিকে প্রশাসনের নাকের ডগায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে খোলামেলা দেদারছে নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা চললেও নেই কোন তদারকি। বই নিয়ে কমিশন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন কতিপয় শিক্ষক সংগঠন। যার ফলে অভিভাবক এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বছরের প্রথম দিন দেশের সব স্কুলে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২ টি নতুন বই। এ ছাড়া প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩২ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য আরো তিন কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৫৩ টি বই ও অনুশীলন খাতা বিতরণ করা হয়েছে।
যশোরের ৮ উপজেলার সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও দাখিল পর্যায়ের প্রায় সোয়া সাত লাখ শিক্ষার্থীর মাঝে মোট ৫৯ লাখ ৩২ হাজার ৫১৬ কপি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রাথমিকে ১৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৬, ইবতেদায়িতে চার লাখ ৮৬ হাজার ৪০০, মাধ্যমিকে ২৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০, দাখিলে সাত লাখ ৯২ হাজার ৫৭৫ ও ভোকেশনাল পর্যায়ে ৪৯ হাজার ৯৪৫ কপি।
কিন্তু যশোর অঞ্চলের সব স্কুলে কতিপয় অসাধু প্রকাশনা, শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে বিভিন্ন পাবলিকেশনের শ্রেণিভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন কালার পেপারের সহায়ক বুক লিস্ট। সেইসব বই কিনতে শিক্ষকদের কমিশনের বিনিময়ে ম্যানেজ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, যশোরের বিভিন্ন স্কুলে ইতোমধ্যে প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করাতে অসাধু শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেই হিসেবে স্কুলগুলো থেকে তাদেরই বই কেনার পরামর্শ দেয়া হয়। সহায়ক বই নিষিদ্ধ থাকলেও ওই বুকলিস্টে দেখা যায় তারকা চিহ্নিত করা বোর্ড প্রকাশিত বইগুলো সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে স্কুল থেকে সরবরাহ হয়। এর পরই এনসিটিটিবি বইয়ের সহায়ক বই হিসেবে তাদের প্রকাশিত মোটা অক্ষরে লেখা বইয়ের নাম। তাদের কৌশল থেকে রক্ষা পায়নি প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও।
সূত্র জানায়, নোট গাইড ও গ্রামার বইয়ের ওপর সরকার বিধি-নিষেধ জারি রয়েছে। সরকারি তালিকাভুক্ত ছাড়া অন্য কোনো নোট গাইড ও গ্রামার বই পাঠ্য তালিকায় আনা যাবে না। শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনশীলতা বিকাশে সরকার বদ্ধপরিকর। এ ছাড়া শিক্ষা যাতে পণ্য না হয়, সে জন্য সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তার পরও থেমে নেই শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। এক শ্রেণির অতিলোভী পুস্তক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ম্যানেজ করে অতি গোপনে সুকৌশলে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন এসব বই। বিনিময়ে লুটে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
যশোর, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জননী, জুপিটার, লেকচার, পাঞ্জেরীসহ বিভিন্ন সিরিজের বই ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীদের এসব বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। যশোর থেকে এ অঞ্চলে এই ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, অনেক প্রকাশনীর পক্ষ থেকে পুস্তক ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছেন। শিক্ষক সমিতির উন্নয়নের নামে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। সমিতির সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান বই পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে সমিতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
এসব বিষয়ে জেলার শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, আনীত অভিযোগ তারা অস্বীকার করেন। যশোর অঞ্চলের লাইব্রেরিগুলোতে নিষিদ্ধ গাইড বই অবাধে বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্রথম শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, যশোর অঞ্চলের অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিদিন শহর ও গ্রামের শত শত শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা শহরের দড়াটানায় উকিলবারের আশেপাশে অবস্থিত লাইব্রেরিগুলোতে গাইড বই কিনতে ভিড় করছেন। এসব বইয়ের দামও চড়া।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২য় শ্রেণির গাইড বই বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণির ২২০ টাকা, ৪র্থ শ্রেণির ২৫০ টাকা, ৫ম শ্রেণির ৫৫০ টাকা, ৬ষ্ঠ ৭৫০ টাকা, ৭ম শ্রেণির ৭৮৫ টাকা ও অস্টম শ্রেণির গাইড বই প্রতি সেট বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। শুধু গাইড নয় শিক্ষকরা এনসিটিবির বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার বই নির্ধারিত থাকলেও শিক্ষার্থীদের সহায়ক বই কিনতে বাধ্য করছেন। আর এসব গ্রামার বই ২৪০ টাকা থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুব পার্থক্য না হলেও ভিন্ন ভিন্ন পাবলিকেশন্সে বইয়ের দামও ভিন্ন। এতে বই কিনতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গরিব অসহায় শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের। সরকার বিনামূল্যে পাঠ্য বই বিতরণ করলেও তা এসব নিষিদ্ধ নোট গাইড ও গ্রামার বইয়ের (উচ্চ মূল্যের) কারণে ম্লান হচ্ছে সরকারের উদ্দেশ্য। সর্বস্তরের মানুষ সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণ কার্যক্রমকে স্বাগত জানালেও নিষিদ্ধ নোট গাইড ও গ্রামার বইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছেন।
শহরের হাসান বুক ডিপোতে গাইড বই কিনতে আসেন সদরের শাহাবাসপুর গ্রামের আব্দুল আলিম। তিনি বলেন, তার ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুলের শিক্ষকরা বলেছেন হাসান বুক ডিপো থেকে জননী প্রকাশনীর গাইড কিনতে। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় তিনি কিনতে পারেননি।
বসুন্দিয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বছরের ৬ মাস পার হলেও গ্রামার ও নোট-গাইডের দাম বেশি হওয়ায় কারণে তিনি কিনতে পারছেন না। শিক্ষকরা বার বার নোট-গাইড কেনার তাগিদ দিচ্ছেন। খুবই বেকায়দায় আছি।
ইছালীর কালু মিয়া বলেন, সরকার বিনামূল্যের বই দিলেও গাইড বই কিনতে আমাদের মতো গরিব অভিভাবকদের খুব কষ্ট হচ্ছে। এদিকে সরকার নজর দিলে ভালো হতো। শুধু আব্দুল আলিম, আব্দুর রাজ্জাক ও কালু মিয়া নয়, এরকম শত শত শিক্ষার্থীর দরিদ্র অভিভাবককে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম বলেন, মূল বই না পড়লে যশোর শিক্ষাবোর্ডের প্রশ্নপত্রের উত্তর করা সম্ভব হবে না। নোট-গাইড জ্ঞানের পরিধি সমীত করে মেধা বিকাশের সুযোগ থাকে না ও শিক্ষার্থীদের পরনির্ভশীল করে তোলে। তাই সবাই নোট-গাইড পরিহার করা উচিত। মূল বই পড়লে ভাল ফলাফল করা সম্ভব ২০১৯ সালে এসএসসির ফলাফলে যশোর শিক্ষাবোর্ডে সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
যশোর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এএসএম আব্দুল খালেক বলেন, সরকার গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। সেই পরিপত্রের চিঠির সব বিদ্যালয়গুলোকে দেয়া হয়েছে। আমাদের অফিসাররা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। কোন বিদ্যালয়ে আমরা নোট-গাইড চালানোর অভিযোগ প্রমাণিত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যশোর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এএসএম আব্দুল খালেক বলেন, সরকার গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। সেই পরিপত্রের চিঠির সব বিদ্যালয়গুলোকে দেয়া হয়েছে। আমাদের অফিসাররা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। কোন বিদ্যালয়ে আমরা নোট-গাইড চালানোর অভিযোগ প্রমাণিত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।