ঈদ সামনে রেখে সীমান্তের কয়েক হাজার চোরাকারবারী রাতদিন সক্রিয়। বেনাপোল-যশোর-খুলনা রুটে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেনটি চোরাকারবারীদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। আর এসব চোরাকারবারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে ট্রেনের জিআরপি পুলিশ ও স্টেশন মাস্টাররা।
ট্রেনের ভিতরে থাকা জিআরপি পুলিশ, ট্রেন চালক, ট্রেনের গার্ডের বিরুদ্ধে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ট্রেনটিতে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে খুলনা জিআরপি পুলিশের কর্মকর্তার পরিচয়ে টাকা তোলেন হাসান, যশোর জিআরপি পুলিশের পরিচয় দিয়ে টাকা তোলেন আইনাল, ট্রেনের চালকের পরিচয় দিয়ে টাকা তোলেন সোহাগও। নাভারণ আবুল সেন্ডিকেটের টাকা তোলে তরিকুল। তবে ট্রেন কর্তৃপক্ষ ও জিআরপি পুলিশ বরাবরের মতো চোরাকারবারীদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
সেন্ডিকেটসহ সব ঘাটকে ম্যানেজ করে কমিউটার এ ট্রেনটি দিয়ে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা, কসমেটিকস, ইমিটেশন গহনা, মসলাজাত দ্রব্য, শিশু খাদ্য, সার, কীটনাশক, বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ মারাত্মক অস্ত্র। চোরাকারবারী এসব পণ্য আসার প্রধান স্থানগুলো হলো গাতিপাড়া তেরঘর দিয়ে। এ সীমান্তের সব চেয়ে বড় সিন্ডিকেট আলিমুর। আলিমুর গাতিপাড়া তেরঘর সীমান্তের দায়িত্বরত বিজিবিদের ম্যানেজ করে মালামালগুলো সীমান্ত দিয়ে পাচার করে থাকে।
এছাড়া দৌলতপুর বড় আঁচড়া, তেরঘর, পুটখালী, সাদিপুর, গোগা, ভুলোট, কায়বা, রুদ্রপুর, ধান্যখোলা, ঘিবা, কাশিপুর সীমান্ত দিয়ে অবাধে প্রবেশ করছে এসব ভারতীয় মাদকদ্রব্য ও মালামাল।
চোরাকারবারীরা সড়ক পথে বিভিন্ন স্থানে স্থানে তল্লাশি চৌকি এড়াতেই তারা ট্রেনটিকে তাদের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছেন। সড়ক পথে বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্ত পার হলে ঢাকা-বেনাপোল সড়কের আমড়াখালি নামক স্থানে বিজিবি চেকপোস্ট, বেনাপোল বন্দর থানা, কায়বা বিজিবি ক্যাম্প, গোড়পাড়া ফাঁড়ি, কাশিপুর বিজিবি ক্যাম্প, নাভারণ হাইওয়ে ফাঁড়ি, শার্শা থানা, ঝিকরগাছা থানা অতিক্রম করা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ ট্রেনের চোরাই পণ্য পরিবহন অনেক সহজ লভ্য ও খরচ কম। বেনাপোল স্টেশনে ট্রেনে অবৈধ পণ্য তোলাটাই শুধু সমস্যা। একবার এসব পণ্য ট্রেনে তোলা হলে বেনাপোল থেকে যশোর, খুলনা আর কোথাও বাধা নেই, নেই কোথাও বিজিবি কিংবা পুলিশ চেক। তাই অধিকাংশ চোরাকারবারীরা বেনাপোলের এ কমিউটার ট্রেনটিকে তাদের পাচারের নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে।
ট্রেনের মধ্যে দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ে পুলিশও ও টিটি নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়ে এসব চোরাকারবারী পণ্যকে বৈধ্যতা দিচ্ছেন। যখনই কোন চোরাকারবারী এসব দালালদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে অস্বীকার করেন তখনই দালাল ও চোরাকারবারীদের মাঝে ট্রেনের মধ্যেই শুরু হয় তুলকালাম।
চোরাচালান প্রতিহত করতে দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি, রয়েছে পুলিশ। তারপরেও চলছে অবাধে এসব ব্যবসা। আর এটাই প্রকৃত বাস্তবতা। এসব অবৈধ্য মালামাল বাংলাদেশে প্রবেশে সহায়তা করছে সীমান্তে টহলরত কিছু অসাধু বিজিবি সদস্য।
ট্রেনটির যাত্রার শুরুর দিকে বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত দিনে এক বার যাতায়াত করত। তবে যাত্রীদের দাবির ফলে বছর খানেক আগে একই ট্রেন সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে বেনাপোল থেকে যাত্রী খুলনার পৌঁছাতে শুরু করেন। একই ট্রেন বেনাপোল থেকে বিকাল ৫টায় যাত্রী নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেন। তবে ট্রেনটি যাত্রীদের কোন সুফল বয়ে না আনলেও চোরাকারবারীদের সুবিধা হয়েছে বহুলাংশে। ট্রেনটি চোরাকারবারীদের পাচারের নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রেনটিতে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ যাত্রীরা লাঞ্ছিত হয় চোরাকারবারীদের হাতে।
এ রুটের যাত্রীরা যশোর খুলনায় যেতে বাসের চেয়ে ট্রেনের ভাড়া অনেক কম এবং আনন্দদায়ক বলে যাত্রীরা দিন ট্রেনে যাতায়াতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কিন্তু একবার যদি কোনো সাধারণ যাত্রী এ ট্রেনে উঠেন চোরাচালানিদের হাতে হেনস্থা হওয়ার ভয়ে তিনি আর দ্বিতীয়বার ট্রেনটিতে উঠতে চায় না। ট্রেনের অধিকাংশ আসনগুলো চোরাকারবারীরা দখল করে মালামাল পাচার করে থাকে। অথচ সাধারণ যাত্রীরা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে দাড়িয়ে দাড়িয়ে গন্তব্যে যেতে হয়। না হয় গাদাগাদি করে বসে থাকতে তিন জনের সিটে ৫ জন করে। তার ওপরে চোরাকারবারীদের ধাক্কা-ধাক্কি সইতে হয় নিরবে।
ট্রেন ছাড়ার পরপরই শুরু হয় চলন্ত গাড়িতে চোরাকারবারীদের মালামাল জানালা দিয়ে ওঠানো-নামানো। কোন যাত্রী প্রতিবাদ করলেই তাকে চোরাকারবারীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়। অথচ এসব চোরাকারবারীরা বেনাপোল থেকে খুলনায় ট্রেনের নির্ধারিত ভাড়া ৪৫ টাকা না দিয়ে ১০ টাকা দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন নিয়মিত।
ট্রেনের একাধিক যাত্রী জানান, বেনাপোল রেলস্টেশন এলাকায় বিজিবির টহল থাকায় সেখান থেকে চোরাকারবারীরা তেমন মালামাল উঠাতে পারে না। তাছাড়া সম্প্রতি সময়ে বিজিবি সদস্যরা চোরাচালান রোধে ট্রেনটিকে নাভারণ স্টেশন পর্যন্ত স্কট করে পার করেন। নাভারণ স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছাড়ার পরে এক কিলোমিটার দূরে নাভারণ ব্রিজের পাশেই চলন্ত ট্রেনটিকে দাঁড় করায় চোরাকারবারীরা। এর পর পরই ট্রেনটিতে চোরাচালানীরা মালামাল উঠানোর প্রতিযোগিতায় নামে। কেউ বা ট্রেনের জানালা দিয়ে, কেউ বা দরজা দিয়ে মালামাল সজোরে চেলে ফেলে। তবে রাস্তার মাঝে ট্রেন দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ট্রেন চালকের আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোল কমিউটারের এক ট্রেন চালক জানান, আমরা রাস্তার মাঝে ট্রেন থামায় কথাটি সাঠিক না। একদল চোরাকারবারী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে। এরপর যেখানে যেখানে তাদের মালামাল থাকে সেখানে গিয়ে ট্রেনের হর্সপাইপ খুলে দিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয়। ফলে সেখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলে চোরাকারবারীরা খুবই দ্রুত্য মালামাল ট্রেনে উঠিয়ে নেয়। অনেক সময়ে চোরাকারবারীরা ট্রেন দাঁড়ানোর জন্য পাথরও নিক্ষেপ করেন। এ অবস্থার মধ্যেই আমাদের এ রাস্তায় ট্রেন চালাতে হয়।
বেনাপোল স্টেশনে সাইদুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, রেলের যাত্রীদের নিরাপত্তা ও চোরাকারবারীদের প্রতিরোধের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রেল পুলিশের। রেল পুলিশ এসব দায়দায়িত্ব পালন না করে বরং চোরাকারবারীদের সঙ্গে তাদের নিবিড় সখ্যতা রয়েছে। ভারত থেকে পাসপোর্ট যাত্রীরা বেনাপোল প্লাট ফর্মে আসলে কিছু জিআরপি পুলিশের সদস্য দৌড়ে তাদের কাছে চলে যায়। এর পরে তাদের কাছে চাঁদা দাবি করে। দাবিকৃত চাঁদা না দিলে তাদের ব্যাগের মালামাল নিয়ে টানা হেঁচড়া করতে থাকে।
বেনাপোল জিআরপি পুলিশের কর্মকর্তা কামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি পাসপোর্ট যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে চোরাচালানীরা অনেক সময়ে খুশি হয়ে তাদের ২০ থেকে ৫০ টাকা দেন বলে তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে খুলনা জিআরপি পুলিশের কর্মকর্তা ওসমান গনি পাঠানের মুঠোফোনে সংযোগ দিয়ে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, আমার জানামতে ট্রেনে জিআরপি পুলিশের পরিচয়ে কেউ টাকা পয়সা তোলে না। তবে আমার নাম-পরিচয়ে কেউ ট্রেনে টাকা তুললে আপনারা তাকে আমাদের কাছে ধরিয়ে দিন বলে তিনি জানান।
সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবির তৎতপরতা সম্পর্কে যশোর ৪৯ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সেলিম রেজার কাছে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবি নিরালসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তার পরেও গভীর রাতে সীমান্ত দিয়ে কিছু মালমাল আসছে। যার অধিকাংশই বিজিবি আটক করতে সক্ষম হচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃ তরিকুল ইসলাম মিঠু